ইস্কুলে ভর্তি হবার কিছুদিন পরেই আমরা এসেছিলাম রাজশাহীতে বেড়াতে। সবাই মিলে বেড়ানোর কি যে মজা টের পেয়েছিলাম সেবার। ট্রেনে করে এসেছিলাম মনে আছে আমার। বাবার কেমন যেন এক বন্ধু থাকতেন রাজশাহীতে, আমরা গিয়ে তাঁর বাসাতেই উঠলাম। রাজশাহীর বাসাগুলো কেমন যেন পুরোনো পুরোনো, আর সেই সময় সাহেব বাজারের বাড়ীগুলো যেন আরো পুরোনো ছিল। একতলা বাড়ি, দোতলায় ছাদে ওঠার প্যাঁচানো একটা সিঁড়ি আর চিলেকোঠা, আর ইয়া মোটা মোটা দেয়াল। এককথায় সেই সময় মারাত্মক লেগেছিল আমার। কাকার অনেকগুলো ছেলে মেয়ের মাঝে দুই ছেলে ছিল নোটন আর ছোটন নাম। ছোটনের সাথে আমার বেজায় খাতির হয়ে গেল। ছোটনের মাথায় রাজ্যের যত দুষ্টামী বুদ্ধি। আমাকে ও শিখাল কিভাবে শক্ত কাগজ ভাঁজ করে গুলি বানিয়ে দুই আঙ্গুলের মাঝে একটা চুল বাঁধা রাবার দিয়ে মারা যায়। আর কারো গায়ে লাগলে সাথে সাথে খুবই জ্বালা করে। আমরা যাকে পাই তাকেই গুলি মারি। সেকি মজা। ছোটন একবার তার বড় বোন তুলিকে গুলি মেরে ভয়ানক মার খেল। এরপর আমরা একটু সাবধানে গুলি মারতে লাগলাম। লুকিয়ে চুরিয়ে, আর বেশির ভাগ সময়ই বকুনি খেল নোটন আর ছোটন।
খুব ছোটবেলা থেকেই মা আমাদেরকে রিডিং পড়া শিখাত। গড়গড় করে পড়তে না পারলে আবার পড়তে হত। মুখে একদম ফেনা উঠে না যাওয়া পর্যন্ত ছাড়া হত না। চরম কষ্টকর এবং বিরক্তিকর একটা ব্যাপার ছিল এই রিডিং পড়া, তবে পরে অনেক কাজে দিয়েছিল আমার এই গড়গড় করে পড়ার ব্যাপারটা। ক্লাসে কোন রিডিং করার দরকার থাকলে বেশির ভাগ সময় আমি পেতাম এই ভার। ষে যাক গে, মার প্রসঙ্গ আসল অন্য একটা কারনে। মা আমাকে দাবা খেলা শিখিয়েছিল অনেক ছোটবেলায়। দুপুর বেলা খাবার পর আমরা মাঝে মাঝেই দাবা খেলতাম।
তো রাজশাহীতে কাকার সাথে দাবা খেলা হল অনেক। আমি ছোট বলেই কাকা ইচ্ছা করে ভুল চাল দিয়ে হেরে যেত। খুব মজা পেতাম আমি, জিতেছি ভেবে। কাকার সাথে একদিন ভোর বেলা আমি বাবা, নোটন ছোটন আর আমার বোনেরা মিলে বের হয়ে দেখলাম কয়েকজন মিলে পদ্মার পাড়ে হাঁসের বিয়ে দিল। খুবই মজা পেয়েছিলাম সেদিন।
ছোটন আর আমি মিলে একটা ভয়ানক বাজে কাজ করছিলাম সেবার। ছাদের উপরে অনেক খোয়া (ছোট ছোট ইঁটের টুকরো) রাখা ছিল কোন কারনে। আমি আর ছোটন মিলে সেগুলো আকাশের দিকে ছোঁড়া শুরু করলাম একদিন, বাসার নিচে রাস্তা, সব খোয়া গিয়ে পড়তে লাগল মানুষজনের গায়ে। আমরা ব্যাপারটা অত আমল দেইনি – হঠাৎ বিশাল এক শোরগোল পড়ে গেল, অনেক গুলো লোক এসে ধমাধম করে বাসার দরজা ধাক্কানো শুরু করল। আমরা কেবল বুঝতে পেরেছি যে কাজটা খুবই সিরিয়াস টাইপের কিছু হয়ে গেছে। আমার আর ছোটনের আত্মারাম প্রায় খাঁচাছাড়া অবস্থা তখন। আমরা কোথায় গিয়ে যেন লুকিয়ে পড়েছিলাম। বাসার বড়রা সবাই বাইরে গিয়ে মানুষজনকে ঠান্ডা করেছিল।
এর কয়েকদিন পরেই আমরা আবার ঢাকায় চলে আসলাম। রেল স্টেশনে আমি আর ছোটন কেঁদেছিলাম অনেক, এত মজার দিন শেষ হয়ে গেল ভেবে। আমি এসএসসি পাশ করার পরপরেই কাকা মারা গেল, আর ছোটন নোটন কেউই পড়াশোনা করল না, ব্যবসা ছিল এদের প্রধান পেশা। ছোটনরাও পড়াশোনা শিকেয় তুলে হয়ে গেল দোকানদার।