গতকাল আমি গরমের ঠেলায় অতিষ্ঠ হয়ে এসি কিনতে গেলাম ট্রান্সকমের একটা শোরুমে, পেপারে তাদের “কাঠফাটা গরমে কাটছে সময় আরামে” দেখে। দোকানে ঢুকতেও শার্ট প্যান্ট টাই পরা একজন বিভিন্ন এসি দেখাতে লাগল। এর মাঝে ট্রান্সটেকের এসি আছে কয়েক মডেলের, হোয়ার্লপুলের আছে একটা মডেল আর জেনারেলের আছে দুই টনের একটা মডেল। আমি দেখে শুনে ঠিক করলাম ট্রান্সটেকের একটা একটন আর হোয়ার্লপুলের আরেকটা দেড়টন নিব আমার দুইটা রুমের জন্য।
তাদেরকে কিছু অ্যাডভান্স পে করে আসা হল সেদিন। আজকে সকালে ডেলিভারী নেবার আগে বাকিটা পে করতে হবে। ভাল কথা, সেলসম্যান আমাকে একটা রিসিট দিল যে টাকা অ্যাডভান্স করা হয়েছে সেটার জন্য। এবার শুরু হল খেলা। এবার তারা বলল যে আমি যে একটনের এসিটার অর্ডার দিয়েছি তা তাদের কাছে নেই, কিন্তু তারা সেটা অন্য শোরুম থেকে এনে দিতে পারবে। ভাল কথা, আমার এসি পেলেই হল। কোন শোরুম থেকে আসছে সেটা আমার ধর্তব্যের মাঝে পড়ে না।
এর পর শুনলাম দোকানে যে একটনের মডেলটা আছে সেটা নাকি পুরোনো, আমাকে দেয়া হবে নতুন মডেলের একটন এসি (যেটা তারা নাকি দোকানে রাখে নাই, স্টকে নাই বলে) – ভাল কথা, তাতেও আমার কিছু যায় আসে না।
আজকে সকালে বেলা সাড়ে দশটার সময় ফোন আসলো – সেই সেলসম্যান ফোন করেছে “স্যার আপনি যদি টাকাটা পে করে যেতেন তাহলে আমি এখুনি ডেলিভারী দিয়ে আসতাম”
আমি জুনেল কে নিয়ে টাকাটা পে করে দিলাম, যেটা বাকি ছিল সেটা। দোকানে ঢুকেই দেখি এক মহিলা আর একজন বৃদ্ধ সেই সেলসম্যানের সাথে রাগতঃস্বরে কথা বলছে। সেলসম্যান সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন
মহিলা: আমার রিমোট টা কাজ করে না কেন, আপনারা আমাকে পুরোনো রিমোট দিয়েছেন
সেলসম্যানের অসিস্ট্যান্ট (অথবা ঐরকম কেউ): ম্যাডাম তাহলে আপনি অমুক ব্রাঞ্চে যান, ওখান থেকে বদলায় নিয়ে আসুন। আমরা কিছু করতে পারব না
মহিলা: পারবেন না মানে? আমি অরিজিনাল রিমোটের জন্য পে করলাম আর আমাকে দিলেন নষ্ট রিমোট? অন্য রিমোট নিতে চাইলে তো বাজার থেকে একশ টাকা দিয়েই কিনতে পারতাম
সেলসম্যানের অ্যাসিস্ট্যান্ট: ম্যাডাম আপনি অমুক ব্রাঞ্চ থেকে বদলিয়ে নিয়ে আসুন, অসুবিধা তো নেই
মহিলা: অমুক ব্রাঞ্চে যাওয়া টা আমার জন্য টাফ, আমি চিনি না, আপনাদের কাউকে দিন
সেলসম্যানের অ্যাসিস্ট্যান্ট: আমাদের কারো পক্ষে তো এই সময় যাওয়া সম্ভব না
মহিলা: তাহলে আমাকে নষ্ট রিমোট দিলেন কেন, টাকা ফেরত দেন
সেলসম্যানের অ্যাসিস্ট্যান্ট: ম্যাডাম টাকা ফেরত নিতে চাইলেও আপনাকে ঐ ব্রাঞ্চ থেকেই নিতে হবে।
আমি আর জুনেল প্রায় দশমিনিট ধরে দাঁড়িয়ে থেকে সার্কাস দেখছি। মহিলার দাবি খুবই যৌক্তিক, তিনি অরিজিনাল রিমোটের জন্য পে করার পরেও তাঁকে ধরিয়ে দেয়া হয়েছে নষ্ট রিমোট। এমন সময় সেলসম্যানের দৃশ্যে আবির্ভাব – তিনি একজন স্টাফ কে ডেকে বললেন – এই যাও যাও তুমি সঙ্গে যাও, যেয়ে বদলায় দাও। সেই স্টাফ তখন সেই মহিলা আর বৃদ্ধের সাথে রওনা হল অমুক ব্রাঞ্চে
এবার আমার টাকা পরিশোধের পালা। আমি টাকা পে করে দিলাম। তারা বলল যে কিছুক্ষনের মাঝেই এসি নিয়ে লোক চলে যাবে। সেলসম্যান তখন একজন টেকনিশিয়ান কে দেখিয়ে বলল ইনি যাবেন। আমি তখন টেকনিশিয়ানের সুবিধার্থে বললাম যে “আমার বাসা অমুক রোডে অমুক মার্কেটের ঠিক অপোজিটে” – শালার টেকনিশিয়ান তখন আমাকে বলে “ঠিকানা তো লেখা আছেই, দেখে নিব”। আমার মেজাজ গরম হয়ে গেল, আরে বাবা আমি তো তার চেনার জন্যই বলতে গিয়েছিলাম। মেজাজ এমনই খারাপ হল যে চুপ হয়ে গেলাম। কিছুক্ষন পরে সেই টেকনিশিয়ান বলে “স্যার রোড নম্বরটা কত?” – কত বড় বজ্জাত, আমি তখন শান্তস্বরে বললাম “ঠিকানা তো লেখা আছেই, দেখে নিবেন”
টাকা পে করে দেয়ার পর সেলসম্যান বলে ঠিক আছে স্যার হয়ে গেছে, আপনি তাহলে যান আমি এসি পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমি অবাক হয়ে বললাম – আমি যে আপনাকে পে করলাম তার মানি রিসিট টা দেবেন না?
সেলসম্যান: স্যার ওটা তো আপনাকে গতকালই দেয়া হয়েছে
আমি: আরে, গতকাল যেটা দিয়েছেন সেটা তো আমি যে অ্যাডভান্স দিলাম সেটার রিসিট, আজকে যে আমি ফুল পে করে দিলাম সেটার রিসিট টা দিন।
সেলসম্যান: স্যার আসলে ঐটাই রিসিট, আমরা তো একজন কাস্টোমারের জন্য দুইটা রিসিট করতে পারি না
আমার তখন মেজাজ চরম খারাপ, আরে বেটা তুমি আমার দুইটা এসির জন্য একটা রিসিট বানালা, তারউপরে বিশ্বের সব জায়গায় যে পেমেন্ট হয় সেটার আলাদা আলাদা ভাবে মানি রিসিট দেয়া হয় আর আজকে এই বেকুব বলে নতুন কথা। আমি বললাম “দেখেন ভাই, আপনার কালকের রিসিটে কিন্তু লেখা নাই যে আমি ফুল পে করেছি, শুধু যেটা অ্যাডভান্স করেছি সেটা লেখা আছে” – সেলসম্যান তখন বলল “ঠিকআছে স্যার আমি তাহলে ট্রান্সকমের প্যাডে হাতে লিখে দিচ্ছি”
এইবার বের হওয়ার সময়। আমি বললাম “ইনভয়েস টা দেন”
সেলসম্যান: স্যার ইনভয়েস তো আজকে পাবেন না, দুই/তিন দিন দেরি হবে
আমি (অবাক হয়ে): মানে? আমি প্রোডাক্ট কিনলাম সেটার ইনভয়েস দেবেন দুই তিন দিন পরে, কেন?
সেলসম্যান: স্যার আসলে আপনার একটন এসি টা অন্য শোরুম থেকে আনা তো, সেজন্য ইনভয়েস দিতে পারছি না। ওদের কাছ থেকে ইনভয়েস আনতে হলে হেডঅফিস হয়ে আনতে হবে।
আমি: ভাই, সেটা আপনার সমস্যা যে আপনি আমাকে এসি হেড অফিস থেকে দিচ্ছেন নাকি আপনার দোকান থেকে দিচ্ছেন নাকি অন্য শোরুম থেকে দিচ্ছেন। আমি ট্রান্সকমের শোরুম থেকে প্রোডাক্ট কিনছি, সো আমার ইনভয়েস টা প্রাপ্য এবং সেটা কেনার সময়েই।
সেলসম্যান: স্যার, আমি খুবই দুঃখিত কিন্তু আমি আসলেই ঐ ইনভয়েসটা দুই দিন পরেই পেয়ে যাবেন। কিন্তু স্যার আমি আপনাকে দেড়টন এসিটার ইনভয়েস এখনই দিতে পারব। আর আমি আপনাকে ইনভয়েস নাম্বার দিয়ে দিচ্ছি, আপনি বললেই পেয়ে যাবেন।
আমি (তখন চরম মেজাজ খারাপ): দেন, সেটাই দেন
সেলসম্যান তখন কম্পিউটারে বসল – তাদের ইনভয়েস সফটাওয়্যার ওপেন করে আমাকে বলল “ওহ স্যার, সেটাও আজকে দিতে পারব না, কারেন্ট নাই”
আমি: আপনার কার্ডটা দেবেন প্লিজ
সেলসম্যান: আমার কার্ড স্যার শেষ হয়ে গেছে, তবে আমি ম্যানেজার সাহেবের কার্ড দিচ্ছি, আমার নম্বর টা লিখে দিচ্ছি
সেলুকাস, একটা ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেটের শোরুম চালাচ্ছে, কম্পিউটার চলছে জেনারেটর দিয়ে আর প্রিন্টারে নাকি কারেন্ট নাই। আমার মনে হচ্ছিল “কবে মানুষ সার্ভিস দেয়া শিখবে, আমি তো আর মাগনা সার্ভিস নিচ্ছি না, তার পরেও এই হল তাদের ব্যবহারের নমুনা”
আমি আর জুনেল এসে গাড়িতে বসলাম। জুনেল বলল – মন খারাপ করে কি আর করবেন, এইটাই অবস্থা। কোনোদিনই ঠিক হবে না।
টেকনিশিয়ান আসল দুপুর বারোটায়, ইন্সটলেশন শেষ করল রাত নয়টা বিশে। নয়টার সময় আমাকে বলল যে “স্যার আপনার সকেটে তো এই প্লাগ ঢুকবে না, নতুন প্লাগ লাগবে”
কেমন লাগে বলেন, সারাদিন কাজ করে শেষমুহুর্তে বলে এই কথা। যখন দোকানপাট আর খোলা পাওয়া যাবে কিনা সেটা কেউই শিওর না। তারপরেও টেকনিশিয়ান দোকানে গেল, একটা প্লাগ কিনে আনল। আমার ঘরে এসি বাতাস দেয়া শুরু করল, টেকনিশিয়ানরাও সালাম দিয়ে সেলামী নিয়ে চলে গেল।
সবকিছুর ষোলকলা পুর্ন হল কিছুক্ষন পরেই। সুমির ঘরের এসি টা ভালই কাজ করছে (হোয়ার্লপুল টা) – আর আমার ঘরের এসির শুধু ফ্যান ই ঘোরে, ঠান্ডা আর হয় না। আধাঘন্টা একঘন্টা চালালাম, ঘর থেকে বাইরে বের হয়ে দেখি সর্বনাশ, আমার ঘরের চেয়ে বাইরেই বরং তাপমাত্রা তিন চার ডিগ্রি কম!!!
কেমন লাগে বলেন, এই হল সার্ভিস, এই হল গ্রাহকসেবা। জয়তু সার্ভিস , জয়তু গ্রাহকসেবা!!